
Majharul Islam
কবি ও সাহিত্যিক
4.0
Story
শৈশব পেরিয়ে কৈশোর যখন উচ্ছ্বল রূপে, আন্তঃ নগর ট্রেনের মতো ঝক-ঝকাঝক শব্দে ছুটে চলেছে সমানতরাল লৌহ-পাতের উপর দিয়ে,তার নিজ গন্তব্যের পানে। তখন আচমকা কালের রোষানল স্বশরীরে এসে সম্মুখে হয় হাজির! সংসার নামক অশরীরি দানব, মানবকে গ্রাসে হ্যাচকা টানে, নেয় ছিনিয়ে তার পানে! বাধ্য হয়েই মাধ্যমিক পাঠশালের ইতি টানি। অতঃপর কুলুর বলদ ন্যায় টেনে চলেছি অহরাত মা ও অনুজদের তরে সংসারের ঘানি। সময় তার নিজস্ব গতিতেই চলে! কারও জন্য তার দায়বদ্ধতা নেই বিন্দুমাত্র। নেই কোন কৈফিয়ত। সময়ের সেই প্রবল স্রোতে পড়ে, জড়াই নিজেকে ব্যবসায়ীদের কাতারে। ব্যবসা করতে যেয়ে প্রথমে দুজন মহতি মানুষের সন্ধান পেয়ে তাঁদের দোকানে কর্মচারীর দায়ীত্ব পালন করতে হয়েছে অনেক দিন। তারপর এক সময় নিজে দোকান খোলে বসি। যা আজও চলেছি সেই ব্যবসায়ী জীবন বয়ে, কালের ঝড় ঝঞ্ঝা সয়ে। মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনে কতোকিছু ঘটে! কতো কিছু রটে! কতো ঘাত-প্রতিঘাত আসে এই ক্ষুদ্র জীবনে! মানুষ চলার পথে কতোজনের সনে হয় সখ্য, তার কোন গানিতিক হিসেব কেউ রাখেনা কোনদিন। বা রাখা সম্ভবও নয়। চলার পথে চলাচলে বহুজন ন্যায়, রেনু নামে একজনের সনে পরিচয় ও সখ্য গড়ে উঠে। সেই রেনু আজ নেই ইহ-জগতে! তাঁর স্মৃতি আমাকে প্রায়ই আচ্ছ্বন্ন করে। সে স্ত্রী-সন্তান আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে গুডবাই জানিয়ে পরপারের ভেলায় চড়ে পারি-জমিয়েছে ওপারে! জানা নেই রেনুর পরিবার আজ কেমন আছে? কেমনে চলে? রেনু একটা সময় ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করে পিতৃ-ভিটা কিশোরগঞ্জে স্থায়ী বসতি গেড়ে। আর সেখানেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। রেনু আর আমি, কিছুদিন গাঙিনার পাড়ে, আল-হাজ ওয়াচ কোং নামক দোকানে চাকুরী করেছি। উক্ত দোকানটি মাথা উঁচু করে ঝলমলিয়ে আজো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে গাঙিনার পাড়ে। দোকানটি রেনুর কাজিনের হলেও রেনু সেথায় বেতনে চাকুরী করতো। আল-হাজ ওয়াচ কোং আছে কিন্তু ইহার প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় গোলাপ ভাই নেই! উক্ত দোকানের বর্তমান কর্ণধার খোকা ভাই পঁয়ষট্টি বসন্ত পার করেও আজও যেন তরুণ! তাঁর বড় ভাই বাচ্চু ভাই, ডায়াবেটিস এ কাবু হয়ে আজও জীবিত আছেন। তাঁদের সনে আমার এখনো গুড সম্পর্ক বজায় রয়েছে। রেনু দেখতে ফর্সা, বেশ হ্যান্ডসাম ও টল ফিগারের ছিল। রেনুর সনে আমার বেশ ভাব গড়ে উঠে অল্প দিনেই। আমরা দুজন সহকর্মী, বয়সেও প্রায় সম-বয়সী ছিলাম। রেনু আমার থেকে দুই তিন বা চার বছরের বড় হবে হয়তো। আমরা সকাল থেকে রাত অব্দি, দুজনেই দোকানে ডিউটি করতাম। দোকান মালিক খোকা ভাইও বসতেন দোকানে। রাত দশটায় দোকান বন্ধ করে আমরা নিজ নিজ বাসায় চলে যেতাম। এটা ছিল রুটিন মাফিক কর্ম। সেটা ঊনিশ শত সাতাশি থেকে নব্বই সাল পর্যন্ত। একানব্বই থেকে আমি নিজে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। সেই পঁচাশি ছিয়াশি সাল থেকে নির্লোভ দেখেছি স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথের উত্তপ্ততা। ছাত্র দলের ওহাব আকন্দ প্রমুখ, ছাত্রলীগের মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, ছাত্র ইউনিয়নের হামিম ভাই, মিল্লাত ভাই ও সজল ভাই, জাসদ ছাত্র লীগের নজরুল ইসলাম চুন্নু ভাই, আরও বহু ছাত্র নেতারা সবাই মিলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর নির্দেশে ময়মনসিংহের রাজপথ প্রকম্পিত রাখতো সর্বক্ষণ। সজল ভাই সাংবাদিক, মিল্লাত ও চুন্নু ভাই বর্তমানে প্রথিতযশা আইনজীবি। সকাল দুপুর আর রাত নাই একের পর এক মিছিল আসতো। তখন প্রায়ই হরতাল হতো। হরতাল পেলেই আমি আর রেনু দুজন বাইসাইকেলে চড়ে নানা স্থানে বেড়াতে যেতাম। গাঙিনার পাড় সংলগ্ন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মহাকালী গার্লস স্কুল অন্যতম। সেই স্কুলের বিভিন্ন মেয়ে স্কুলে যাওয়া আসার পথে ঘড়ি কিনতে বা নতুন ঘড়ি কী এসেছে তা দেখতে, হেন নানা বাহানায় আমাদের দোকানটিতে ঢু-মারতো। আমরা সব সময় ওদের সনে ভালো আচরণ ও হাসি খুশি কথাবার্তা বলতাম। হেন প্রীতির বন্ধনে আমরা ছিলাম বন্ধি। কারও মনে কোন খারাপ ভাব বা কু-চিন্তা কখনই উদিত হতোনা। যদিও সৃষ্টির শাশ্বত চাহিদার টান দেহমনে উদিত হতো। আর সেই শাণিত ক্ষুরধার টানে তনুমন ব্যাকুল থাকতো। কিন্ত সামাজিক পারিপার্শ্বিক বিবেচনায়, বিশেষ করে ব্যবসায়িক দিকটি বিচার বিশ্লেষণে, সেই অমিয় ভাবকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল সর্বদাই আপ্রাণ।
চলবে---
on test